জীবনের অপর পৃষ্ঠা (পর্ব-৩৩)

লেখক – কামদেব

[তেত্রিশ]
—————————

        রিলিফ সোসাইটিতে গেছিল দিন সাতেকের উপর হল।আর কোনো খবর নেই।টাকা যা পেয়েছিল শেষ হতে চলল।একটু বেহিসেবী খরচ হয়ে গেছে।কলেজ থেকে পাড়া হয়ে ফিরবে স্থির করে রত্নাকর।বাড়ীটা কতদুর হল দেখে আসা যাবে।ময়নাকে ওখানে পাঠায়নি তো?রঞ্জা আণ্টির ফ্লাট এড়াবার জন্য ঘুর পথ ধরল।পাড়ায় বেশিক্ষন থাকবে না।হেটে যাবে সরদার পাড়া।অটোভাড়াটা অন্তত বাচবে।
সামনে মনে হচ্ছে তনিমা?কিন্তু সঙ্গে ছেলেটা তো সুদীপ নয়।তে-রাস্তার মোড়ে গিয়ে ছেলেটি ডান দিকে বাক নিল।এবার একা তনিমা।এত আস্তে হাটছে রত্নাকর মুস্কিলে পড়ে যায়।ভাবছে দেখেনি ভাব করে দ্রুত ওকে পার হয়ে যাবে নাকি? যেই ভাবা সেই কাজ, রত্নাকর মাথা নীচু করে হনহন করে হাটতে শুরু করল।সবে ওকে অতিক্রম করেছে, পিছন থেকে ডাকল,এই রতি না?
রত্নাকর থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তনিমাকে দেখে অবাক হবার ভান করে বলল,তুমি?কেমন আছো?
–তুমি আমাকে দেখোনি না এড়িয়ে যাচ্ছিলে বলতো?
–এড়িয়ে যাব কেন?আসলে একটা ব্যাপার চিন্তা করছিলাম–।
–বার বার ধরা পড়েও মিথ্যে বলার স্বভাব তোমার গেলনা।
–স্বভাব যায়না মলে।হেসে বলল রত্নাকর।
তনিমা মনে মনে ভাবে স্বভাব যাবে ঠ্যাঙানি খেলে।কি একটা না দুটো গল্প ছাপা হয়েছে বলে দেমাগ ধরেনা।তনিমা বলল,তোমাকে দেখিনা,কোথায় থাকো এখন?
–সরদার পাড়া।সুদীপের খবর কি?
–ওর নাম আমার সামনে বলবেনা।
রত্নাকর ভুল দেখেনি।বঙ্কা একদিন বলেছিল তনিমা নাকি সুদীপকে এড়িয়ে যেতে চাইছে।
–এখন কার নাম শুনতে তোমার ভাল লাগে?রত্নাকর মজা করে বলল।
–নিজেকে বেশি বুদ্ধিমান ভাবো?তনিমা ব্যঙ্গের সুরে বলল।
–মনে হচ্ছে তুমি রাগ করেছো?বোকার কথায় কিছু মনে কোরনা।
তনিমা কিছু বলেনা।দুজন চুপচাপ হাটতে থাকে।রত্নাকরের মনে হল তনিমা কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
–রতি তুমি সহজেই সবাইকে বিশ্বাস কর।
রত্নাকর বোঝে এটা ভুমিকা।তনিমা বলল,সুদীপ তোমার সম্পর্কে কি বলেছে জানো?
–কি বলেছে?
–সে আমি মুখে আনতে পারব না।
রতি ভাবে সুদীপ কি এমন বলেছে যা মুখে আনা যায়না?অবশ্য তনিমার কথা সত্যি বলে ধরে নেওয়া ঠিক হবেনা।সুদীপের প্রতি বিরূপতা জন্মাক সেই উদ্দেশ্যে বানিয়েও বলতে পারে। তনিমা আড়চোখে রত্নাকরকে দেখে।সত্যিই কি ওর ঐটা সুদীপ যতটা বলেছিল তত লম্বা?প্যাণ্টের উপর থেকে বোঝা যায়না। কেমন নির্বিকার হাটছে দেখো,যেন মেয়েদের নিয়ে কোন আগ্রহ নেই।সুদীপকে গিয়ে লাগাবে।বয়েই গেল তনিমা ঐসবে ভয় পায়না।পঞ্চাদার  দোকানের কাছাকাছি পৌছে তনিমা বলল,তুমি যাও।আমার সঙ্গে দেখলে তোমাকেও খারাপ ভাববে।
রত্নাকর গতি বাড়িয়ে দিল।তনিমা অনেকটা পিছিয়ে পড়ল।
পঞ্চাদার দোকানে ঢুকতেই দেখল সুদীপও আছে।সন্দিহান চোখে তাকে দেখছে।বঙ্কা বলল,অনেকদিন বাচবি।একটু আগে তোর কথাই হচ্ছিল।
বঙ্কা একটু বেশি কথা বলে কিন্তু ওর মনটা পরিস্কার।রত্নাকরের ভাল লাগে,জিজ্ঞেস করল,আমাকে নিয়ে কি কথা?
–ওর সঙ্গে তোর কি কথা হচ্ছিল?সুদীপ জিজ্ঞেস করে।
–কার সঙ্গে?
–ন্যাকামি করিস নাতো,ভেবেছিস দেখিনি?একসঙ্গে এলি এখানে এসে আলাদা হয়ে গেলি–।
–তনিমার কথা বলছিস?কি আবার “তোমাকে দেখিনা–কোথায় থাকো” এইসব।ঐ বলছিল আমি শুনছিলাম।
–কি বলছিল সেটাই তো শুনতে চাইছি।সুদীপের গলায় উষ্ণতা।
সুদীপের জেরা করা শুনে রত্নাকর বিরক্ত হয়।বঙ্কা বলল,ছাড় তো একটা চরাইকরা মেয়েকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝামেলা।
–বঙ্কা মুখ সামলে কথা বলবি।সুদীপ গর্জে ওঠে।
–শোন সুদীপ,আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে তেরাস্তার মোড়ে তার আগে একটা ছেলের সঙ্গে আসছিল।বলার মত তেমন কোন কথা হয়নি।আর যদি কোনো গোপন কথা হতও আমি সেকথা কাউকে বলতাম না।
বঙ্কা জানে রতির লাগানি ভাঙ্গানির স্বভাব নেই।যা বলার সামনা সামনি বলবে নাহলে বলবেই না।
উমাদা ঢুকেই রতিকে দেখে বলল,কিরে তুই বেলাবৌদির সঙ্গে দেখা করেছিলি?
–চলো,তুমি চ্যারিটি অফিসে যাবে তো?
ওদের সঙ্গে বঙ্কাও বেরিয়ে পড়ল।পুরানো সবার সঙ্গে দেখা হবে সেই ভেবে এসেছিল।সুদীপের সঙ্গে ফালতু ঝামেলা,রত্নাকরের ভাল লাগেনি।বঙ্কা সান্ত্বনা দিল,দাগা খেয়ে মেজাজ খারাপ,ওর কথায় কিছু মনে করিস না।ফুটিয়ে দিয়েছে তবু প্রেম শুকিয়ে যায়নি।
–তোর চলছে কিভাবে?উমানাথ জিজ্ঞেস করল।
থতমত খেয়ে রত্নাকর বলল,এই এদিক-ওদিক করে চলে যাচ্ছে।জীব দিয়েছেন যিনি অন্ন যোগান তিনি।
–হে-হে-হে,তুই শালা কথায় ওস্তাদ।বঙ্কা টিপ্পনী কাটে।
রতির কথায় উমানাথ সন্তুষ্ট না হলেও আর কথা বাড়ায় না।বঙ্কা না থাকলে হয়তো আরো কথা জিজ্ঞেস করত।
বেলাবৌদি বারান্দায় অন্ধকারে বসে আছেন।উমারা চ্যারিটি অফিসে ঢুকে গেল,রতি বারান্দায় কলাপসিবল গেটের কাছে দাড়াতে বেলাবৌদি ঠেলে গেট খুলে দিল।বারান্দায় একটা বেতের চেয়ারে বসল রতি।বেলাবৌদি জিজ্ঞেস করল,চা খাবি তো?
রতি হাসল।বেলা চা আনতে গেল।রতি বুঝতে পেরেছে উমাদা তার কথায় সন্তুষ্ট হয়নি।কিন্তু উমাদাকে সন্তুষ্ট করতে বলার মত কি আছে?ময়না ভাত দেয় বা আম্মাজী টাকা দিয়েছে বললে আরো হাজারো প্রশ্ন তৈরী হত।
বেলা চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকে দু-কাপ নামিয়ে রেখে বলল,ট্রে-টা অফিসে দিয়ে আয়।
রত্নাকর অফিসে চা দিয়ে ফিরে আসতে বেলাবৌদি জিজ্ঞেস করে,মনীষার সঙ্গে দেখা হয়েছিল,তোর খোজ করছিল?
–উমাদা তো কিছু বলেনি।কি ব্যাপারে তুমি জানো?
–ওর ছেলের ট্যুইশনির জন্য।চায়ে চুমুক দিয়ে বলল বেলা।
একটু আগে উমাদাকে মিথ্যে বলেছে ভেবে,চোখের পাতা ভিজে যায়।বেলাবৌদিকে বানিয়ে বলল,সরদার পাড়ায় কটা ট্যুইশনি করছি,তাছাড়া এতদুরে এসে পড়ানো সম্ভব নয়।তুমি কেন ডেকেছো বললে না তো?
–এমনি।অনেকদিন তোকে দেখিনা,তোর সঙ্গে কথা বলতে বেশ লাগে।
রতি লজ্জা পায়।বেলা জিজ্ঞেস করল,যে বইটা দিয়েছিলাম,পড়েছিস?
–মোটামুটি।
বেলা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।রত্নাকরের মনে হয় বৌদির মনে কিছু একটা বিষয় আন্দোলিত হচ্ছে। ভাবছে বলবে কি বলবে না।রতির চা খাওয়া হয়ে গেলে হাত থেকে কাপটা নিয়ে  পাশে সরিয়ে রেখে বেলাবৌদি বলল,একটা ব্যাপারে খুব খারাপ লাগছে।
রত্নাকর সজাগ হয় কি বলতে চায় বৌদি।বেলা বলল,তোদের বাড়ীর ব্যাপারে তোর দাদাকে পিছন থেকে কে পরামর্শ দিয়েছিল জানিস?তোদের বিজুদা–আমার স্বামী।
রত্নাকর হাসল।বেলা অবাক হয়ে বলল,তুই হাসছিস?তোর খারাপ লাগছে না?
–বৌদি একজন নিরক্ষর আদিবাসী মেয়ে একটা সুন্দর কথা বলেছিল,কারো ভাগের জিনিস কেউ নিতে পারেনা।তুমি একটা বই পড়ার কথা জিজ্ঞেস করেছিলে,তোমাকে বলি।একটা কুট তর্ক আছে ডিম আগে না মুরগী আগে?তার উত্তর আমার জানা নেই।কিন্তু এটা জানি তত্ত্ব অনুযায়ী ঘটনা ঘটেনা,ঘটনা থেকে তত্ত্বের সৃষ্টি।চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে অনেক শিক্ষার আছে।
–তুই বলছিস আমার সঙ্গে যা ঘটছে সব আমার ভাগ্যে ছিল?
–তুমি বিদুষী তোমাকে বলা আমার শোভা পায়না।মানুষ চিরকাল এক জিনিস নিয়ে  থাকতে পারেনা,বদল চায়।বিয়ে হয় তারপর সন্তান হয়–এইভাবে বদল হয়।
–আমার সন্তান নেই তার জন্য দায় কি আমার একার?বেলা বাষ্পরুদ্ধ গলায় বলল।
রত্নাকর দম নেবার জন্য থামল।তারপর আবার শুরু করল,কিছু মনে কোর না আমার ভুল হতে পারে।একটা সিনেমা দেখেছিলাম “গল্প হলেও সত্যি।”সেখানে এক বাড়ীতে ভাইয়ে ভাইয়ে মিল ছিলনা,সবাই সবাইকে সন্দেহ করত।বাড়ির পাচক একভাইকে বানিয়ে বলত,অন্যভাই তার খুব সুখ্যাতি করছে।এইভাবে সব ভাইকে বলে বলে সংসারে আবার শান্তি ফিরিয়ে আনল।
বেলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,তার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক?
রত্নাকর হেসে বলল,সম্পর্ক কিছু নেই।বিজুদার মনে  ব্যক্তিগত কিছু হতাশা আছে।যা হতে চেয়েছিল হতে পারেনি।এই সময় তোমার সহায়তার খুব প্রয়োজন ছিল।সত্যি করে ভেবে বলতো তুমি বিজুদার কাজকে কখনো এ্যাপ্রিসিয়েট করেছো?বরং নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য পাচজনের কাছে হেয় করেছ।
বেলা উদাসভাবে গ্রিলের ফাক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে।একসময় উঠে গ্রিলের কাছে গিয়ে দাড়ায়,অদ্ভুত চোখের দৃষ্টি।রত্নাকর উঠে বেলাবৌদির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,তুমি আমার উপর রাগ করলে?
বেলা চোখ তুলে রতিকে কিছুক্ষন দেখল তারপর আচমকা রতিকে জড়িয়ে ধরে বলল, এইজন্য তোকে খুজছিলাম।রতি তোকে খুব ভাল লাগে।
রত্নাকর অস্বস্তিবোধ করে,কেউ দেখলে অন্য সমস্যা তৈরী হবে।মোবাইল বেজে উঠতে বৌদির বাহুবন্ধন হতে মুক্ত হয়ে কানে লাগায়।ওপাশ শোনা গেল,রিলিফ সোসাইটী।
রতি আড়চোখে বৌদিকে দেখে বলল,হ্যা বলছি,বলুন….কাল আড়াইটের মধ্যে গিয়ে রিপোর্ট করব?..ঠিক আছে, রাখছি।
সামান্য সময়ে রতি ঘেমে গেছে।মেয়েদের নরম বুক যেন শান্তির শয্যা,বিধাতার অবাক করা  সৃষ্টি। বৌদির চোখে কৌতুহল কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করল না।
রত্নাকর যেচে বলল, কাল সন্ধ্যেবেলা নয় আড়াইটের সময় পড়াতে যেতে হবে।
উমাদা বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করল,তুই কি যাবি নাকি দেরী হবে?
রতি বলল,আসি বৌদি?
রতি বেরিয়ে উমাদা আর বঙ্কার সঙ্গে যোগ দিল।উমানাথ জিজ্ঞেস করে,কেন ডেকেছিল বৌদি?
–ঐ কেমন আছিস কোথায় থাকিস?পাড়ায় দেখিনা আজকাল–এইসব।
হাটতে হাটতে বঙ্কা বলল,বৌদির সঙ্গে বিজুদার সম্পর্কটা ভাল যাচ্ছেনা।
–তুই কি করে বুঝলি?রতি জিজ্ঞেস করে।
–আমাদের সামনেই কি ঝগড়া।বিজুদা বলল নিজেকে খুব পণ্ডিত মনে করো?তারপর–।
উমানাথ বাধা দেয়,এইজন্য সবাই তোকে পছন্দ করেনা।সব কথায় তোর দরকার কি?
–যা সত্যি তাই বললাম।কে কি বলল কিছু যায় আসেনা।আমি নিজে দেখেছি গলতায় ঢুকে তনিমাকে কিস করছে সেই ছেলেটা।চরাইকরা মেয়ে নয়তো কি?
উমাদা অভিমান করে নিজের ভাইপোকে পড়াবার কথা বলল না।রতি ভাবে বললে মুষ্কীলে পড়ে যেতো।
এতরাত হয়ে গেল সেই অটোতে উঠতেই হবে।অবশ্য কাল মনে হয় কিছু পাওয়া যাবে।
অটো স্ট্যাণ্ডে গিয়ে হোটেলে ঢূকে ভাত খেয়ে নিল।নীচে কাঠমিস্ত্রীরা তাস খেলছে।রত্নাকর হ্যারিকেন জ্বেলে পড়তে বসল।এতরাতে মোবাইল বাজছে,কে হতে পারে? সুইচ টিপে কানে লাগাতে শুনল,বাচ্চা?
আম্মু ফোন করেছে।রত্নাকর উচ্ছসিত হয়ে বলল, হ্যা আম্মু।
–কি করছিস বাচ্চা?
–তুমি বলেছো পড়শুনা করতে–পড়ছি আম্মু।তুমি কেমন আছো?..হ্যা খবর দিয়েছে….ঠিক আছে দেখা করব..রাখছি?
ফোন রেখে রতি ভাবে,সে কী আম্মুর সঙ্গে অভিনয় করল?আবার মনে হয় একটা মানুষ যা যা করে সব সময় কি স্বেচ্ছায় সচেতনভাবে করে?

চলবে —————————