জীবনের অপর পৃষ্ঠা (পর্ব-৮)

লেখক – কামদেব

[আট]
—————————

সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে।রাস্তায় লোক চলাচল বাড়তে থাকে।  প্রথমদিন তাড়াতাড়ি ফিরে আসে উমানাথ।ছেলেকে নিয়ে কিহুক্ষন আগে ফিরেছে  মনীষা।দরজা খুলে উমানাথকে দেখে হেসে  জিজ্ঞেস করে,ঠাকুর-পো কেমন লাগল অফিস?
ঘেমো জামা খুলে চোখে মুখে জল দিয়ে বসতেই মনীষা চা নিয়ে ঢুকলো।
–বৌদি আগে ভাবতাম খুব বুঝি খাটতে হবে।
–কদিন যাক,নেশা ধরে যাবে।দেখছো না তোমার দাদাকে?পাঁচটায় ছুটি বাড়ী ফিরতে ফিরতে আটটা-নটা বেজে যায়।এ্যাই জানো আজ রতির সঙ্গে দেখা হল।
–কি বলল?
–কি বলবে?আমিই মজা করে বললাম,কারো সঙ্গে প্রেম-টেম করছিস নাতো?একেবারে ঘেমে নেয়ে একসা।খিল খিল করে হেসে ওঠে মনীষা।
–ও খুব লাজুক আর ইমোশনাল।সামান্য কিছু হলেই চোখে জল চলে আসে।
–ইমোশন থাকা ভাল আবার–।
–আবার মানে?উমা জিজ্ঞেস করে।
–এক একসময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে।
–কেউ একটু দরদ দেখালে একেবারে কেলিয়ে পড়ে।উমার মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে যায়।
–এ আবার কেমন কথা?ঠাকুর-পো ভাষা সংযত করো।তোমার ভাই-পো বড় হচ্ছে।
উমানাথ লজ্জা পেয়ে যায় বল্লে,স্যরি বৌদি।
চা টিফিন খেয়ে বেরিয়ে পড়ল উমানাথ। পঞ্চাদার দোকানে এসে দেখল আড্ডা জমজমাট। সবাই রতিকে নিয়ে পড়েছে। শুভ বলল, এতক্ষণ কোথায় ছিলি? কিরে রতি ডুবে ডুবে প্রেম করছিস নাকি?
রত্নাকর চমকে ওঠে,শুভ কেন একথা বলল?সামলে নিয়ে রত্নাকর বলে,এখানে বসেই সব বুঝে গেলি?
–গায়ের গন্ধে বোঝা যায় বস।
–সবাইকে তোর মত ভাবিস নাকি?রত্নাকর সকলকে এড়িয়ে নিজের জামার গন্ধ শোকে।ঘামের গন্ধ ছাড়া আর কোনো গন্ধ পায়না।
বঙ্কা মাঝখানে নাক গলায়,লেখকদের এত মাথা গরম করলে চলে?
শুভ বলল,রাগ করছিস কেন?বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে ঠাট্টা ইয়ার্কি করা যাবেনা?সবাই রোজিকে নিয়ে আমাকে যখন বলে আমি কিছু বলেছি?পঞ্চাদা লেখককে একটা চা দাও।
–আমি কি বাদ? উমানাথ দোকানে ঢুকে বলল।
–আরে তুমি?পঞ্চাদা দুটো চা করো।বলো অফিস কেমন লাগল?
–তোরা খাবি না?
–আমাদের এক প্রস্থ হয়ে গেছে।আবার পরে খাবো।
রত্নাকরের কোনো কথা কানে যায় না সে ভাবে রোজি আর জানু এক নয়।জানুর কথা কাউকে বলা যাবেনা।পরক্ষনেই শঙ্কা হয় আবার দেখা হলে সব ভুলে যাবে না তো?
উমানাথ মাছি তাড়ানোর মত বলল,ছাড়তো অফিস।শোন এবার কাজের কথা বলছি। তোদের মেনু করার দরকার নেই?
সুবীর বলল,তুমি কিন্তু কথা দিয়েছো।
–আজ বুধবার।আগামী রবিবার দুপুরবেলা আমাদের বাসায় সকলের মধ্যাহ্ন ভোজন।
–তোমার বাসায়? দাদা থাকবেনা?
–থাকলে থাকবে।বৌদি তোদের যেতে বলেছে,ব্যাস।উমা বলল।
–বৌদি আমাকে কিছু বলল নাতো?রত্নাকর বলল।
–তুমি কে হরিদাস?তোমাকে আলাদা করে বলতে হবে?বঙ্কা টিপ্পনী কাটে।
উমা বিরক্তি প্রকাশ করে,কি আরম্ভ করলি তোরা?খালি কাঠিবাজি। কলেজ কবে খুলছে?
–সোমবার।
–ব্যাস।তাহলে রবিবার?কিরে রতি অসুবিধে নেই তো?
–অসুবিধের কি আছে?আমি আসছি,অনেক সকালে বেরিয়েছি।
রত্নাকর দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামে।উমাদা পাশে এসে জিজ্ঞেস করে, তোকে কেমন অন্যরকম লাগছে,কিছু হয়েছে?
ফ্যাকাশে হেসে বলল রত্নাকর,কি আবার হবে?
–সেদিন কিছু খেয়েছিলি?
অবাক হয়ে তাকায় রত্নাকর।উমানাথ বলল,ঐ যেদিন খুব বৃষ্টি হোল?
রত্নাকর বুঝতে পারে সঞ্জয় হয়তো কিছু বলেছে।হালকাভাবে বলে,কি খাবো?রোজ যা খাই তাই খেয়েছি।তোমায় কেউ কিছু বলেছে?
–বৌদি বলছিল,লেখকরা খুব আবেগ প্রবণ।
–মনীষাবৌদিকে আমার খুব ভাল লাগে।
–আবেগে মানুষ অঘটনও ঘটাতে পারে।
–মানে?
–বৌদি একটা সুন্দর কথা বলেছে।
–কি কথা?
–এক সময় সতীদাহ প্রথা ছিল।অনেক ভীরু রমণী আবেগের বশে স্বামীর চিতায় আত্মবিসর্জন দিত অবলীলায়।
–ধর্মীয় আবেগ।
–যাইহোক আবেগ। রবিবার,মনে আছে তো?
উমাদা চলে গেল পঞ্চাদার দোকানে।মনীষাবৌদির সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে।উমাদা ভাগ্যবান অমন বৌদি পেয়েছে।চোখের সামনে দাউ-দাউ চিতার ছবি ভেসে ওঠে,লক লক করছে লেলিহান শিখা।জনাকে আগুনের শিখার মত লাগে।আবার দেখা হলে মিলিটারি আণ্টির মত হয়তো আজকের কোনো কিছুই মনে থাকবে না।নজরে পড়ল রাস্তার একধার দিয়ে রোজি হাটতে হাটতে তাকে আড়চোখে দেখছে।সম্ভবত শুভর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে।নটা বেজে গেছে এতরাতে বেরিয়েছে কিসের টানে? জানকেও তার দেখতে ইচ্ছে করছে।প্রেম হলে কি এমন হয়?শুভ কি রোজির সব দেখেছ?রত্নাকর ক্লান্ত পায়ে বাড়ীর দিকে হাটতে থাকে।
উমানাথ ভাবে রতিকে একটা ট্যুইশনি জোগাড় করে দেওয়া দরকার।আজকাল সবাই চায় স্কুল টিচার।স্কুল টিচার হলেই ভাল পড়াবেন?স্কুলে পড়াতেন সুরেনবাবু স্যার।উমানাথের মনে পড়ল।অঙ্ক শেখাতেন।পটপট করে বোর্ডে অঙ্ক করে দিতেন কিন্তু কিভাবে করছেন কিছুই বুঝতে পারত না উমানাথ।শুভ হেলান দিয়ে বসে মাঝে মাঝে দৃষ্টি চলে যাচ্ছে রাস্তার দিকে।বঙ্কার নজর এড়ায় না।
জিজ্ঞেস করে,কি বস কথা আছে?
–নিজের চরকায় তেল দে।শুভ বলল।
বঙ্কা চুপ করে যায়।উমানাথ রতি আর বঙ্কা ছাড়া সকলেরই কেউ একজন আছে।বয়সে বড় উমানাথ কিছু বলেনা রতির অন্যের ব্যাপারে তেমন কৌতুহল নেই।বঙ্কাটার সব ব্যাপারে কৌতুহল।শুভ ঝট করে দোকান থেকে বেরিয়ে পড়ল।বঙ্কা লক্ষ্য করে,দূরে রোজি হেটে চলেছে।আগেরটা কেটে যাবার পর শুভ রোজিকে ধরেছে।মিলি শুভকে ভাগিয়ে দিয়েছে,শুভ বলে সেই নাকি মিলিকে ভাগিয়েছে।দলের মধ্যে রতিটাই সব থেকে লাল্টু দেখতে অথচ ওর কিছু হলনা কেন কে জানে?রতিটা একটু ক্যালানে টাইপ।
রোজি আগে আগে হাটছে শুভ একটু পিছনে।শুভ পিছন থেকে ফিসফিস করে বলল,ডানদিকে–ডানদিকে।
রোজি দাঁড়িয়ে পড়ে,ডানদিকে মানে নির্মীয়মান ফ্লাটে ঢুকতে বলল।শুভর মতলব বুঝতে পারে।শুভ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,দাঁড়িয়ে পড়লে?
–না না আজ নয়।পিকনিকের দিনের ব্যাপারটা মা মনে হয় জেনে গেছে।
–তাতে কি হয়েছে?আমরা কি অন্যায় করেছি?
–তা নয়।বিয়ের আগে মানে–।
–তার মানে তুমি আমাকে বিশ্বাস করোনা?
–তোমাকে নয় নিজেকে বিশ্বাস করিনা।
–তার মানে?
–কিছু একটা হয়ে গেলে মুখ দেখাতে পারবো?
–তুমি আমাকে এত ছোট ভাবো?আমি কি ঐসব করার কথা বলেছি?
উমানাথ দোকানে ফিরে শুভকে না দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করে,শুভ চলে গেছে?
বঙ্কা অদ্ভুত ভঙ্গী করে বলল,শুভ এখন গোলাপের গন্ধ নিচ্ছে।
উমা বুঝতে পারেনা,সুখেন বলল,সব ব্যাপারে চ্যাংড়ামি।রোজির সঙ্গে গেছে,এখুনি এসে পড়বে।
বাড়ীর কাছাকাছি আসতে মায়ের আকুল চোখদুটোর কথা মনে পড়ে।দাদাও তো মায়ের ছেলে তবে তার জন্য এত কেন চিন্তা?দাদা মাকে একটু দেখল না,সেও যে মায়ের জন্য কিছু করে সে সামর্থ্য নেই।  রত্নাকর বাসায় ঢুকতে মা জিজ্ঞেস করল,সেই কখন বেরিয়েছিস,এতক্ষনে সময় হল? আমি এদিকে ভেবে মরি।
–সন্ধ্যেবেলা এসেছি।পঞ্চাদার দোকানে ছিলাম।এত ভাবো কেন,আমার কি হবে?
–তোমার কিছু হবেনা,ভাবি যখন থাকবনা তখন তোর কি হবে?
রত্নাকর ক্ষুব্ধ হয়ে বলে,কথায় কথায় তুমি একথা বলো কেন?আমার শুনতে ভাল লাগে?
মনোরমা ছেলের মুখের দিকে মমতাভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন।ঠোট ঈষৎ প্রসারিত করে হেসে বললেন,বাবা মানুষের কথা কি বলা যায়?যা ঘরে যা।এখন চা খাবি নাকি?
নির্মীয়মান বাড়ি থেকে বেরিয়ে রোজি বলল,কি করলে বলতো?জামার বোতামটা ছিড়ে গেছে।
–চেন লাগানো জামা পরতে পারোনা?
–হ্যা তোমার জন্য বুক খোলা জামা পরে আসব।
–বাড়ি গিয়ে সেলাই করে নেবে।শুভ বলল।
–আহা মা যদি দ্যাখে?
–কিচছু হবেনা।প্যাণ্টি তো ছিড়িনি।
–খালি অসভ্যতা।প্যাণ্টি ছিড়তে দিলে তো?
সুরঞ্জনার খাওয়ার দাওয়ার পাট শেষ।ললিতাও খেয়ে শুয়ে পড়েছে।মনটা বেশ হালকা লাগছে, কম্পিউটার খুলে বসলেন।
কটা বাজে এখন?মনে হয় অফিসে।সুরঞ্জনা টাইপ করেন,
Hello
সাড়া দিচ্ছেনা,ব্যস্ত নাকি?একটু পরেই ফুটে ওঠে,
Good morning,mom how are you?
very well how are you?
health well? arthritis problem?
Do not tension no a problem. sorry mom I can not go this year.
OK.
his workload and tight schedule.
When the time will come when there will be all right.
are you angry?
Do not worry for me.
now I am in office,bye
তার মানে এখন সকাল।  পলি এবছর আসছেনা।প্রতি বছরই বলে সামনের বছর।কিন্তু সময় হলে নানা অজুহাত।আলমারি খুলে একটা সার্টিনের ড্রেসিং গাউন বের করেন।মলি এনে দিয়েছিল, একদিনও পরেননি।ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দু-হাত ঢুকিয়ে পরলেন।সামনে বোতাম নেই।কোমরে ফিতে দিয়ে বাধতে হয়।মনটা আজ বেশ খুশি খুশি।ছেলেটা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?
রত্নাকর ঘুমায়নি।খাওয়া দাওয়ার পর তার ডায়েরী লেখা অভ্যেস।সামনে ডায়েরী খোলা,গভীর চিন্তায় ডুবে আছে।
বিবাহে দেওয়া-নেওয়া প্রেমে কেবল দেওয়া।জনার কথাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে।জনার সঙ্গে তার প্রেম,হাসি পেল।মনের মধ্যে একটা আকুলতা আছে তার মানেই সেটা প্রেম?মেয়ে পটিয়ে কি প্রেম হয়?শুভর সঙ্গে মিলির একসময় প্রেম ছিল।তারপর জোর করে অসভ্যতা করতে গেলে মিলি ওর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে।একে কি প্রেম বলা যায়?প্রেমের সঙ্গে বিয়ের ওতপ্রোত সম্পর্ক।বিয়ের পর কেমন হবে জীবন যাপন সেই ভাবনাই প্রেমের পথে বাধা।ভালো লাগা থেকেই প্রেমের উদ্ভব।উচু ডালের ফুল ভালো লাগলেও থেকে যায় অধরা।খুশিদিকে ভাল লাগতো,খুশিদির সঙ্গে থাকতে কথা বলতে ভালো লাগতো।খুশিদি বয়সে একটু বড় তাও।খুশিদিকে যদি বলত,খুশিদি আই লাভ ইউ।তাহলে খুশিদি খিল খিল হেসে গড়িয়ে পড়ত।
নিজে প্রেমের গল্প লিখেছে অথচ প্রেম নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই ভেবে রত্নাকর অবাক হয়।মিষ্টি কথা বলে তাকে দিয়ে ম্যাসাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য এই কৌশল।রত্নাকর বোঝেনা তা নয় আসলে মুখের উপর বলতে মায়া হয়।রত্নাকর মনে মনে হাসে,সে নিজেই আজ দয়া মায়ার পাত্র। সব কিছুকে আমরা ভাল মন্দ ইতিবাচক নেতি বাচক দিয়ে বিচার করি কিন্তু ভাল মন্দ মিশিয়েই মানুষ।সেই বাদলার দিন মিলিটারি আণ্টির যে চরিত্র সামনে এল তাতো আণ্টির ভিতরেই ছিল। লোকে কি বলবে ভেবে বাইরে বেরোতে পারছিলনা।অনুকূল পরিবেশ পেয়ে বেরিয়ে পড়েছে।মিলিটারি আণ্টির প্ররোচনা ছিল,না থাকলে হয়তো ঘটনাটা ঘটতো না।তাহলেও আমার মধ্যে কি ইচ্ছেটা সুপ্তভাবে ছিলনা তা কি জোর দিয়ে বলা যায়?লোকলজ্জার ভয়ে বা অসম্ভব বিবেচনা করে অনেক ইচ্ছেকে আমরা কি জোর করে দাবিয়ে রাখিনা?
ফোন বাজতে দেখল,জনা। ধরবে কি ধরবে না ভাবছে,ফোন বেজেই চলেছে।ফোন তুলে কানে লাগিয়ে বলল,হ্যালো?
–ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
–না না শুয়ে শুয়ে তোমার কথা ভাবছিলাম।
–আমারও ঘুম আসছে না।বুকের মধ্যে কেমন করছে–শুনতে পাচ্ছো?
রত্নাকরের পুরুষাঙ্গ শক্ত হয়ে ওঠে, ঘুমোবার চেষ্টা করো জানু।
–কাল আসবে তো?
এক মুহূর্ত ভেবে ফিস ফিস করে বলল,এখন রাখছি।মা আসছে।
রত্নাকর ভাবে সেও দুষ্টু কম না।আসলে মজা করার জন্য মিথ্যে বলা।

চলবে —————————